স্টাফ রিপোর্টার” শেখ জুয়েল রানা’
ঢাকা, ২৩ মার্চ ২০২০: বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি করোনা ভাইরাস সংক্রমণের সর্বশেষ পরিস্থিতি বিবেচনা করে এটি ‘জাতীয় দুর্যোগ’ হিসেবে ঘোষণা করা এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে জাতীয় দুর্যোগ কমিটি গঠন করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মতই লকডাউন, আংশিক লকডাউন, প্রতিষ্ঠানিক কোয়ারান্টাইন ও হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। ২৩ মার্চ পার্টির সভাপতি কমরেড রাশেদ খান মেননের সভাপতিত্বে ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সভায় এই আহ্বান জানানো হয়।
স্কাইপের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত এই সভায় বলা হয়, ইতিমধ্যেই ৩টি মূল্যবান মাস অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যেসব ব্যবস্থার কথা বলেছেন বাস্তবে তার অস্তিত্ব দেখা যায় নি; চরম সমন্বয়হীনতা সেখানে কাজ করছে। রোগতত্ব বিভাগ তাদের সাথে পরীক্ষার জন্য যোগাযোগ করতে হটলাইনে কথা বলতে বললেও তাদের সংযোগ পাওয়া যায় না অথবা রোগীর বিদেশ ফেরত না বলে তাদের পরীক্ষাও করা হয় না। মিরপুরে টোলারবাগের ঘটনা তার প্রমাণ। একইভাবে একজন সাংবাদিক ও ডাক্তারের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও তার প্রমাণ। তাছাড়া মাত্র ১টি পরীক্ষাগার দিয়ে কিভাবে এত সংখ্যক ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষা হতে পারে। যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার জোর দিয়ে পরীক্ষা করার কথা বলেছে। দুর্ভাগ্যজনক যে, প্রতিটি বিভাগে একটি করে পরীক্ষাগার স্থাপনের ওয়ার্কার্স পার্টির দাবিও উপেক্ষিত হয়েছে। ফলে ঢাকা থেকে সিলেটের রোগীর নমুনা সংগ্রহের আগেই সে মারা গেছে। এবং তাকে করোনা ভাইরাস সংক্রমিত বলে দাফন করা হলেও এখনও রোগতত্ব বিভাগ তা নিশ্চিত করতে পারেনি। একই সময় বেসরকারি হাসপাতালগুলো যেখানে সুবিধা রয়েছে সেগুলোকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে এনেই এই পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করা যেতে পারতো বলেও ওয়ার্কার্স পার্টি দাবি জানিয়েছিল। কেবল মাত্র কীট সংগ্রহেই তিন মাস চলে গেল। আর স্বাস্থ্য কর্মীদের সুরক্ষা ব্যবস্থা (পিপিই) এখনও পর্যন্ত সেভাবে সরবরাহ করা হয়নি। এর ফলে যাদের সর্দি-কাশি শ্বাসকষ্টের সামান্যতম উপসর্গ রয়েছে তাদের হাসপাতালগুলো এবং প্রাইভেট চেম্বারও ফিরিয়ে নিচ্ছে। ওয়ার্কার্স পার্টি মনে করে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের বাস্তবতা সর্বোচ্চ নেতৃত্বকে সঠিকভাবে জানানো হচ্ছে না। যে জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে সেটাও একবারও বসেনি বলে সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ। ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর বিবৃতিতে বলা হয়, আর সময় নেই এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।

ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সভায় আরও বলা হয় যে, করোনা ভাইরাস সংক্রমণের সতর্কতার কারণে নিম্ন শ্রমজীবীরা গৃহকর্মীরা বস্তিবাসীরা গণপরিবহন কর্মীরা এক কথায় যারা দিন আনে দিন খায় তারা চরম অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছে। শ্রমঘন শিল্প গার্মেন্টস শ্রমিকদেরও একই অবস্থা। এদিকে ক্রয় আদেশ বাতিল করার ফলে গার্মেন্টস কারাখানাগুলো সংকটে পড়েছে। এই অবস্থায় এক শ্রমজীবী ও বস্তিবাসী মানুষের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় ২ সপ্তাহের খাদ্য সরবরাহ (২) গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য মালিকদের সহায়তা প্রদান এবং সর্বোপরি সকল নিম্ন বেতনভুক সরকারি-বেসরকারি কর্মচারিদের এই সময়ের জন্য দুর্যোগ ভাতা এবং (৩) সবার স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করা জরুরি। সকল মহানগরের মেয়র ও কাউন্সিলদের মাধ্যমে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তৎপরতায় এবং এমপিদের তত্ত্বাবধানে এই ব্যবস্থা করার আহ্বান জানিয়েছে ওয়ার্কার্স পার্টি। একই সঙ্গে যারা এই পরিস্থিতিতে বাজার মূল্য বৃদ্ধি করছে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
ওয়ার্কার্স পার্টি একই সঙ্গে লক্ষ্য করছে যে, যেকোনো মহামারীতে সতর্কতা অবলম্বন ধর্মীয় বিধান রয়েছে সেখানে পরিচিত কিছু ধর্মবাদী নানা রকম অপপ্রচার ও উত্তেজনামূলক এবং মিথ্যা কথা বলে চলেছে যা বন্ধ করা জরুরি।
ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরো সভা করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির মধ্যেও ঢাকাসহ ৩টি উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্বাচন কমিশনের বালখিল্যতার সমালোচনা করা হয় এবং বলা হয়, এর ফলে নির্বাচন সম্পর্কে আস্থা আরও তলানীতে চলে গেল।
ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরো এতদসত্ত্বেও দুর্যোগ মুহূর্তে বাংলাদেশের জনগণের ক্ষমতার প্রতি আস্থাবান। কেবলমাত্র সহায়তা পেলেই তারা এই দুর্যোগ মোকাবেলা করে পৃথিবীর সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।
ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সভায় আগামী ২ সপ্তাহ সকল প্রকার সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড স্থগিত রেখে জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি অব্যাহত রাখার জন্য পার্টির সকল স্তরের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। এই সময়কালে পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড ফজলে হোসেন বাদশার সাথে স্কাইপে যোগাযোগ রাখতে সকল জেলাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
পলিটব্যুরোর সভায় স্কাইপে সংযুক্ত হন পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড ফজলে হোসেন বাদশা, পলিটব্যুরোর সদস্য কমরেড আনিসুর রহমান মল্লিক, কমরেড মাহমুদুল হাসান মানিক, কমরেড ড. সুশান্ত দাস, কমরেড নুর আহমদ বকুল, কমরেড কামরূল আহসান, কমরেড মুস্তফা লুৎফুল্লাহ প্রমুখ।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণের সর্বশেষ পরিস্থিতি বিবেচনা করে এটি ‘জাতীয় দুর্যোগ’ হিসেবে ঘোষণা করা এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে জাতীয় দুর্যোগ কমিটি গঠন করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মতই লকডাউন, আংশিক লকডাউন, প্রতিষ্ঠানিক কোয়ারান্টাইন ও হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করার দাবী সমর্থন করে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মৌলভীবাজার জেলা সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য, অারপি নিউজের সম্পাদক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ অামিরুজ্জামান বলেন, “গুজব বা আতঙ্ক না ছড়িয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সচেতন হওয়ার অাহবান জানাচ্ছি।
১. পৃথিবীর অন্যতম ঘন জনবসতিপূর্ণ দেশ হিসেবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের বিষয়। বাংলাদেশের জন্য বিমানবন্দরের চাইতেও অনেক ক্ষেত্রে স্থল ও নৌবন্দরগুলো অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, কেননা আমদানি-রপ্তানির জন্য আমরা এই বন্দরগুলো বেশি ব্যবহার করে থাকি। সুতরাং বিমানবন্দরে নজরদারি জারি রাখার পাশাপাশি স্থল ও নৌবন্দরগুলোতে সরকারের অস্থায়ী মেডিকেল পোস্ট স্থাপন ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা উচিত।
২. ঢাকা শহরের কিছু হাসপাতাল এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য কিছুটা প্রস্তুত হলেও সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাসপাতাল ও চিকিৎসাসেবা করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের জন্য অপ্রতুল। গত বছর ঢাকার বাইরে যেভাবে ডেঙ্গুর বিস্তার হয়েছে তাতে করে দেশের সবগুলো জেলা শহরে ও ইউনিয়ন পর্যায়ে একাধিক হাসপাতাল ও মেডিকেল টিম সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত রাখা দরকার। যেহেতু বিদেশ প্রত্যাগত শ্রমিক ও প্রবাসীরা বেশিরভাগ সময়ে সরাসরি গ্রামে চলে যান, তাই তারা যাতে আক্রান্ত হলে তাৎক্ষণিক সেবা ও পরামর্শ পেতে পারেন সেই ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৩. টেলিভিশন, রেডিও, অনলাইন ও প্রিন্ট মিডিয়ায় সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর করোনা ভাইরাস বিষয়ক জরুরি তথ্য-উপাত্ত নিয়মিত প্রচার করা জরুরি। এছাড়াও বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হলে সব রোগীকে ভর্তি করে বিচ্ছিন্ন রাখার মতো পর্যাপ্ত বেড আমাদের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে নেই। তাই এই ক্ষেত্রে বর্তমানে ক্যানাডার গৃহীত পদক্ষেপ ‘self-isolation’ কার্যকরী হতে পারে। এই ক্ষেত্রে রোগী করোনাভাইরাস পজিটিভ হলে সে নিজস্ব তত্ত্বাবধানে ১৪ দিনের জন্য নিজ ঘরে বিচ্ছিন্ন থাকবে। এমতাবস্থায়ও প্রয়োজনের সময় তৎক্ষণাৎ চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা দরকার।
৪. সরকার চীনে প্রচুর হ্যান্ড স্যানিটাইজার, টিসু, টয়লেট পেপার পাঠিয়েছিলো, যা প্রশংসনীয়। নিজের দেশের জনগণও যাতে তাদের প্রয়োজনীয় মাস্ক, স্যানিটাইজার, সাবান, টিসু, টয়লেট পেপার ইত্যাদি প্রয়োজনের সময় পায়, সেই ব্যবস্থা সরকারকেই নিতে হবে।
৫. বাজার নিয়ন্ত্রণ সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। খুব স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন দেশের সরকার যেভাবে মানুষকে self-isolation, অর্থাৎ নিজের ঘরের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে বলছে, তাতে করে মানুষ বাজার-ঘাটে কম যেতে চাইবে, এবং ফলশ্রুতিতে জিনিসপত্র কিনে ঘরে রেখে দিতেও চাইবে। সরকারকে মানুষকে আশ্বস্ত করতে হবে যে নিয়মিত হাত ধুলে, ঘরের বাইরে কিছু স্পর্শ না করলে, বা স্পর্শ করে নাক-মুখ-চোখ ধরার আগে হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে নিলে কোন চিন্তা নেই। সেইক্ষেত্রে একবারে একমাসের বাজার করে রাখারও প্রয়োজন নেই। ৬. ইরান বা যুক্তরাজ্যে সরকারের শীর্ষ এমপি, মন্ত্রীরা করোনাতে আক্রান্ত হয়েছেন। এটাকে ভয় হিসেবে না দেখে সরকারের দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের করোনা টেস্ট করে মানুষকে রিপোর্ট জানানো উচিত স্বচ্ছতার খাতিরে। মিডিয়া হাউজগুলোও নিজ উদ্যেগে নিজেদের করোনা টেস্ট করে পত্রিকার মাধ্যমে মানুষকে জানাতে পারে।
৭. এই প্যানডেমিকে চিকিৎসক, নার্স ও সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের কিন্তু কোনো মুক্তি নেই। তারা চাইলেও নিজেদের self-isolation এ নিতে পারবেন না, যেমনটি পারেননি ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও। তাই ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসা কিংবা জনস্বাস্থ্যসেবা পেশাজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা রাখুন, আস্থা রাখুন। তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ান। তারা যাতে নিজেদের অসহায়বোধ না করেন।”